ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বা উড়ালসড়ক প্রকল্পের নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল সাড়ে তিন বছরে। ১০ বছরের বেশি সময় পার হওয়ার পর জানা যাচ্ছে, কাজের সার্বিক অগ্রগতি মাত্র ২৮ শতাংশ। পুরো কাজ কবে শেষ হবে তা নিয়েও রয়েছে সংশয়।
রাজধানীর যানজট কমাতে যে দুটি প্রকল্প সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হয়েছিল, সেগুলো একটি এই উড়ালসড়ক, অন্যটি মেট্রোরেল। উড়ালসড়কের শুরু ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে। বনানী, তেজগাঁও, মগবাজার, কমলাপুর, সায়েদাবাদ হয়ে এটি যাবে ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত। দৈর্ঘ্য ২০ কিলোমিটারের মতো।বিজ্ঞাপনবিজ্ঞাপন
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, উড়ালসড়কটি চালু হলে যানবাহন ৮০ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারবে। এ হিসাবে বিমানবন্দর এলাকা থেকে কুতুবখালী যেতে মোটামুটি ২০ মিনিট সময় লাগার কথা। পুরো পথে মোট ১৫টি ওঠার ও ১৬টি নামার জায়গা থাকবে। এর পাশাপাশি ফার্মগেট হয়ে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ এবং কাঁটাবন হয়ে পলাশী মোড় পর্যন্ত উড়ালপথে দুটি সংযোগ সড়কও থাকবে। ফলে সুফল পাবেন ওই এলাকাগামী মানুষেরাও।
২০১১ সালের ৩০ এপ্রিল এই প্রকল্পের নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর আরও দুই দফা নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। শুরুতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১১ হাজার ৯২০ কোটি টাকা, যা ১ হাজার ৯৩৮ কোটি টাকা বেড়েছে।বিজ্ঞাপন
উড়ালসড়কের কাজ হচ্ছে তিন ভাগে। প্রথম ভাগ বিমানবন্দর থেকে বনানী পর্যন্ত সাড়ে সাত কিলোমিটার। দ্বিতীয় ভাগ বনানী থেকে মগবাজার রেলক্রসিং পর্যন্ত ছয় কিলোমিটারের কিছু কম। তৃতীয় ভাগ মগবাজার থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ছয় কিলোমিটার। সেতু বিভাগের নথিপত্র অনুযায়ী, ১০ বছরে সার্বিক কাজ মাত্র ২৮ শতাংশ হলেও বিমানবন্দর থেকে বনানী পর্যন্ত অগ্রগতি ৬৫ শতাংশের মতো। বনানী থেকে মগবাজার পর্যন্ত কাজ চলছে। বাকি অংশে কাজ শুরুই হয়নি।
উড়ালসড়ক প্রকল্পের পরিচালক এ এইচ এম এস আকতার প্রথম আলোকে বলেন, আগামী বছর জুনের মধ্যে বিমানবন্দর থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত চালুর একটি লক্ষ্য রয়েছে। বাকিটা পরে হবে। তিনি বলেন, এখন কাজের গতি ভালো। টাকার সমস্যাও কেটেছে। করোনার কারণে একটু সমস্যা হচ্ছে।
ব্যয় কতটা বাড়ল, কত দাঁড়াল
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে (পিপিপি) নেওয়া প্রকল্পগুলোর একটি উড়ালসড়ক। এটি বাস্তবায়ন করছে সেতু বিভাগ। উড়ালসড়ক প্রকল্পের দুটি ভাগ। মূল কাঠামো নির্মাণ এবং সহযোগী প্রকল্প। চুক্তি অনুযায়ী, মূল কাঠামো নির্মাণ ব্যয়ের ২৭ শতাংশ অর্থ বিনিয়োগ করবে সরকার। বাকি ৭৩ শতাংশ বিনিয়োগ করবে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান। এ কাজে শুরুতে ব্যয় ধরা হয় ৮ হাজার ৭০৩ কোটি টাকা। ২০১৩ সালে তা ২৩৭ কোটি টাকা বাড়িয়ে ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা ধরা হয়।
সহযোগী প্রকল্পের পুরো ব্যয় সরকারের। জমি অধিগ্রহণ, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন, বিভিন্ন সেবা সংস্থার লাইন সরানো ও পরামর্শকদের ব্যয় মেটানোর জন্য এ প্রকল্প নেওয়া হয়। শুরুতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩ হাজার ২১৭ কোটি টাকা। পরে তা ১ হাজার ৭০১ কোটি টাকা বাড়িয়ে ৪ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা ধরা হয়েছে।
সেতু বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, ব্যয় এতটা বেড়ে যাওয়ার কারণ প্রকল্প বাস্তবায়নে বাড়তি সময় লাগা। সহযোগী প্রকল্পের ব্যয় যেহেতু পুরোটা সরকার বহন করছে, তাই এ খাতে ১ হাজার ৭০১ কোটি বাড়তি খরচের টাকা সরকারি কোষাগার থেকেই দিতে হবে। সব মিলিয়ে প্রকল্পটির সর্বশেষ ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা, যা আরও বৃদ্ধির আশঙ্কা আছে বলে জানিয়েছে সেতু বিভাগ সূত্র।
বড় দায় ইতাল–থাইয়ের
উড়ালসড়ক নির্মাণের কাজ করছে থাইল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইতালিয়ান-থাই ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি, যেটি ইতাল–থাই নামে পরিচিত। ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে প্রতিষ্ঠানটিকে কাজের দায়িত্ব দেয় সরকার। কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৪ সালে। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে কাজ শুরুই হয়নি।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, উড়ালসড়কের নির্মাণকাজে বিলম্বের কারণ তিনটি। ২০১১ সালের শুরুতে চুক্তি করার পরও নকশা বদল ও জমি অধিগ্রহণ জটিলতায় দুই বছরের মতো দেরি হয়। পরে ২০১৩ সালের মাঝামাঝিতে ইতাল–থাইয়ের সঙ্গে নতুন চুক্তি করে সেতু বিভাগ। ২০১৪ সালের ৩০ অক্টোবর এবং ২০১৫ সালের ১৬ আগস্ট দুই দফা নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। কিন্তু কাজ চলে ঢিমেতালে।
উড়ালসড়ক প্রকল্পে দেরি হওয়ার জন্য বড় দায় ইতাল–থাইয়ের। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, ইতাল–থাইকে কাজ দেওয়া হয়েছিল নিজের টাকা বিনিয়োগ করার শর্তে। কিন্তু নির্মাণকাজের টাকা জোগাড় করতেই কোম্পানিটি লাগিয়ে দেয় ৯ বছর।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে ইতাল–থাইকে ৩ আগস্ট ই–মেইল করা হয়। তবে সাড়া পাওয়া যায়নি।বিজ্ঞাপন
বিমানবন্দর থেকে বনানী পর্যন্ত অগ্রগতি
প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বিমানবন্দর থেকে বনানী পর্যন্ত উড়ালসড়কের অনেকটাই দৃশ্যমান হয়েছে। কোথাও পিলার উঠে গেছে। কোথাও কোথাও স্ল্যাব বসিয়ে পথও তৈরির কাজ চলছে। তেজগাঁও রেললাইনের পাশের বস্তি উচ্ছেদ করে জমি পরিষ্কার করা হয়েছে। প্রকল্প এলাকা নিরবচ্ছিন্ন করতে ভাঙা হয়েছে কিছু স্থাপনাও। তবে মগবাজার থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত কাজ দৃশ্যমান হয়নি।
এদিকে দেখা দিয়েছে নতুন জটিলতা। ইতাল-থাইয়ের সঙ্গে চুক্তির এক জায়গায় বলা হয়েছে, বিনিয়োগকারী যে বিদেশি ঋণ নেবে, এর সুদের জন্য কর দিতে হবে না। শর্তে না থাকলেও এর সঙ্গে বাড়তি হিসেবে প্রকল্পে ব্যবহৃত পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধায় কেনার দাবি করেছে ইতাল–থাই।
সূত্র জানিয়েছে, গত বছরের ২৯ জুন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) জানিয়ে দিয়েছে, কর ও শুল্ক সুবিধার কোনোটাই দেওয়া সম্ভব নয়। এরপর গত ফেব্রুয়ারিতে ইতাল–থাই আবার কর ছাড়ের আবেদন করে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, এই বিষয়ে এখনো দেনদরবার চলছে।
‘আসল উদ্দেশ্য পূরণ হয়নি’
উড়ালসড়ক নির্মাণে মোট জমি লাগছে ২২০ একর। এর মধ্যে মাত্র ২৬ একর ব্যক্তিমালিকানাধীন। সবচেয়ে বেশি জমি নেওয়া হয়েছে রেলওয়ের কাছ থেকে। এ ছাড়া সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, রাজউকসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থার কিছু কিছু জমি আছে। ফলে সহজেই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সুযোগ ছিল। সরকারও জমি বেশ সহজ শর্তে ইতাল–থাইকে দিয়েছিল।
কথা ছিল, চালুর পর ২১ বছর উড়ালসড়কটি থেকে টোল আদায় করবে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান। এ সময় বাংলাদেশ ফি হিসেবে পাবে মাত্র ২৭২ কোটি টাকা। তবে তা একবারে নয়, বছর বছর।
উড়ালসড়কের বিনিয়োগকারীর সঙ্গে চুক্তিতে একটি টোল হারও উল্লেখ করা হয়েছে। প্রাইভেট কার ও মাইক্রোবাস পুরো পথ চললে দিতে হবে ১২৫ টাকা। মাঝপথ থেকে ওঠানামা করলে টোল ১০০ টাকা। বাসের ক্ষেত্রে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। তবে টাকা দিয়েও সহজ যাত্রার সুযোগ শুধু বিলম্বিতই হচ্ছে। রাস্তায় দুর্ভোগে রয়েছে মানুষ।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, সরকার পদ্মা সেতুর পরই সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়েছিল উড়ালসড়ক প্রকল্পে। এর কারণ ছিল ঢাকায় তখন প্রস্তাবিত অন্য প্রকল্পের কারণে যে চাপ তৈরি হওয়ার আশঙ্কা ছিল, তা থেকে ঢাকাবাসীকে কিছুটা স্বস্তি দেওয়া। তিনি বলেন, সময়ক্ষেপণের কারণে আসল উদ্দেশ্য পূরণ হয়নি। উল্টো ব্যয় বেড়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে কতটা উপকার হবে, সেই প্রশ্নই দেখা দিয়েছে।