স্কুল-কলেজের বইগুলোতে,টিভি,নিউজে মাদার তেরেসাকে অনেক মহান দেখানো হয়।আসলে কি তিনি এত মহান ছিলেন?উনি কি নিজের স্বার্থের জন্য মানবতার কাজ করেছিলেন?এসব প্রশ্নগুলো কি কখনো আমাদের মাথায় এসেছে?নাকি যাচাই-বাছাই ছাড়া আমরা এখনো ইতিহাসের অখাদ্যকে গোগ্রাসে গিলি?
একজন বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব হিসেবে তিনি মাদার টেরিজা বা তেরেসা নামে অধিক পরিচিত,তার মৃত্যুর আগে ও পরে বিশ্বের বিভিন্ন ব্যক্তি,সংস্থা ও একাধিক রাষ্ট্রের সরকার দ্বারা নন্দিত ও নিন্দিত হয়েছে।তেরেসা ও তার প্রতিষ্ঠিত ‘দ্য মিশনারিজ অব চ্যারিটি’র (দাতব্য ধর্মপ্রচারক সংঘ) ক্রিয়াকলাপ অসংখ্য বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
সমালোচকরা তেরেসার সংঘের সেবার নিম্নমান,বলপূর্বক ধর্মান্তর ও মৃত্যুপথযাত্রীদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষাদানের নিন্দা জ্ঞাপন করেছে এবং তাদের সাথে উপনিবেশবাদ ও বর্ণবাদের সম্পর্ক পেয়েছে।
তেরেসা গণযোগাযোগ মাধ্যমে আলোচিত ছিলেন। অনেক সমালোচক মনে করেন,ক্যাথলিক গির্জা খ্রিস্টানধর্ম প্রচার ও সমালোচনার মোকাবেলা করতে তেরেসার ভাবমূর্তি ব্যবহার করেছে।
অস্ট্রেলিয়ান নারীবাদী জার্মেইম গ্রিয়া তেরেসাকে ‘ধর্মীয় সাম্রাজ্যবাদী’ বলে সমালোচনা করেছেন।
অনেকে তাকে উন্মত্ত উগ্রবাদী, মৌলবাদী তথা ভণ্ড বলে আখ্যায়িত করে বলেছেন যে তিনি নিজের ধর্মীয় আদর্শ তথা ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করতে দুস্থবঞ্চিতদের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন।
মাদার তেরেসার উপনিবেশবাদী ও বর্ণবাদী প্রকল্পঃ
বিজয় প্রসাদ মাদার তেরেসাকে ‘উপনিবেশবাদ ও বর্ণবাদের ধ্বজাধারী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।তার মতে,তেরেসা উপনিবেশিত দেশে ধর্মপ্রচারক শ্বেতাঙ্গ নারীদের প্রতিভূ রূপে ক্রিয়ারত ছিলেন।মনে হয় যেন তিনি কালো মানুষদের স্বীয় কামনা ও অপারগতা থেকে রক্ষা করতে এসেছেন!
এখনও উপনিবেশবাদী কুচিন্তা ধারণ করে যাওয়া ইউরো-মার্কিন মিডিয়া মনে করে যে কালো মানুষদের বদলাবার বিশেষ ক্ষমতা শ্বেতাঙ্গদের রয়েছে।তেরেসার কর্ম পশ্চিমা বৈশ্বিক প্রকল্পেরই অংশ যা বুর্জুয়া পাপবোধকে দাতব্য সংস্থার মাধ্যমে বিলুপ্ত করতে চেয়েছিল।কিন্তু যে সমাজকাঠামো(পুঁজিবাদ) দারিদ্র্য উৎপাদন করে,সে সমাজকাঠামোকে না বদলিয়ে টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে দাতব্য সংস্থার ভূমিকা অনেক।
অরূপ চট্টোপাধ্যায় বলেন,”ভারত থেকে এখনো উপনিবেশী মানসিকতা দূর হয়নি, তাই সাধারণ মানুষ তেরেসার মতো সাদা মহিলাকে সমালোচনা করতে ভয় পায়।”
বলপূর্বক খ্রিস্টধর্ম দীক্ষাঃ
তেরেসার বিরুদ্ধে অন্যতম অভিযোগ,তিনি সেবা গ্রহণ করতে আসা অসহায় দুঃস্থ মানুষদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হতে চাপ দিতেন।তেরেসার সংঘের ‘সবকিছুই ছিল খ্রিস্টান হবার শর্তে’ – সে খাবার হোক বা শোবার জায়গা হোক।
অরূপ চট্টোপাধ্যায় আরো বলেন,
“তেরেসা নিজেই ১৯৯২ সালে স্বীকার করেন, তিনি প্রায় ২৯ হাজার লোককে তাদের মৃত্যুর সময় না জানিয়ে খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত করান। আমার মতে আসল সংখ্যাটা লক্ষের কাছাকাছি হবে।”
অর্থসংক্রান্ত কেলেঙ্কারিঃ
অনেক অসৎ ও দুর্নীতিবাজ ব্যক্তির কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ তথা গৃহীত অর্থের অস্বচ্ছ ব্যয়ের জন্যও টেরিজা সমালোচিত হয়েছেন।
অনেক বড় বড় অনুদান পেলেও তিনি সেবার মান উন্নতিকরণে উল্লেখযোগ্য ব্যয় করেননি।জার্মান পত্রিকা স্টার্ন-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী অনুদানের মাত্র ৭ শতাংশ সেবা দানের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হত, টেরিজা নিজে বিশ্বের সেরা হাসপাতালে সর্বদা ১ম শ্রেণীর উৎকৃষ্ট চিকিৎসা নিতেন এবং অধিকাংশ সময় সংরক্ষিত বিমানে বিশ্ব পরিভ্রমণে ব্যস্ত থাকতেন।
ক্রিস্টোফার হিচেন্সের মতে,তেরেসা কুখ্যাত, দুর্নীতিবাজ প্রতারকদের কাছ থেকে বড় বড় অনুদান নিয়েছেন।যেমনঃ তেরেসা এক মিলিয়ন ডলার অনুদানকারী চার্লস কিটিং ঋণ জালিয়াতি মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলে তেরেসা বিচারককে কিটিং-এর চারিত্রিক সদগুণ কীর্তন করে চিঠি দিয়েছিলেন।তেরেসাকে কিটিং-এর ২৫২ মিলিয়ন ডলার ঋণ জালিয়াতির তথ্যপ্রমাণ পাঠানো হলেও তিনি অনুদান ফেরত দেননি।
চিকিৎসা সেবার নিম্নমান
ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল দ্য ল্যাঞ্চেটের সম্পাদক রবিন ফক্স ১৯৯১ সালে কলকাতায় টেরিজার সেবাদান প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে চিকিৎসার মানকে অগ্রহণযোগ্য ও অপরিচ্ছন্ন বলে সমালোচনা করেছেন। ফক্স বলেন, চিকিৎসাশাস্ত্রীয় বিদ্যা ছাড়াই টেরিজা ও তার সংঘ রোগীদের সম্পর্কে দেখা শোনা করে এবং তারা নিরাময়যোগ্য ও নিরাময়-অযোগ্য রোগের মাঝে কোন পার্থক্য করে না ফলশ্রুতিতে নিরাময়যোগ্য রোগীও মৃত্যুর সম্মুখীন হতে পারে। মন্ট্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল পর্যবেক্ষকও একই মত প্রকাশ করেছেন।
মাদার তেরেসার প্রতিষ্ঠিত চ্যারিটি নিয়ে সমালোচিত খবরঃ
“মাদার তেরেসা চ্যারিটি হোমে শিশু বিক্রির অভিযোগ উঠেছে। জানা যায় ১৪ বছর বয়সী এক শিশুকে বিক্রির অভিযোগে ভারতের ঝাড়খন্ডে অবস্থিত মাদার তেরেসার প্রতিষ্ঠিত মিশনারিজ অব চ্যারিটির এক নারী কর্মীকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য একই কেন্দ্রের আরও দুই সিস্টারকে নিয়ে গেছে পুলিশ।
রাজ্যের চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির (সিডব্লিউসি) কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়ার পরই এ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।সিউব্লিউসি চেয়ারম্যান রুপা কুমারি বলেন, ‘অন্যান্য কয়েকটি শহরে ৫০ হাজার থেকে ৭০ হাজার রুপিতে এর আগেও এই কেন্দ্র(ঝাড়খণ্ডের চ্যারিটি) থেকে শিশু বিক্রি হয়েছে।”