সম্প্রতি ‘পঞ্চগড় আবার উত্তপ্ত কাদিয়ানীরা মুসলমানদের বাড়িতে আগুন দিয়েছে, ২ জনকে হত্যা করেছে।’ শীর্ষক শিরোনামে একটি তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার করা হচ্ছে।
ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে ও এখানে।
আর্কাইভ দেখুন এখানে, এখানে, এখানে ও এখানে।
গতরাল রাতে পঞ্চগড়ে কাদিয়ানী মুসলিম সংঘর্ষ দাবিতে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে।
আর্কাইভ দেখুন এখানে।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, গত রাতে পঞ্চগড়ে কাদিয়ানীরা মুসলমানদের বাড়িতে আগুন দিয়েছে এবং দুইজন মুসলমানকে হত্যা করেছে দাবিতে প্রচারিত তথ্যটি সঠিক নয় বরং কোনোপ্রকার তথ্য প্রমাণ ছাড়াই উক্ত দাবিটি ভিত্তিহীনভাবে ফেসবুকে প্রচার করা হয়েছে।
দাবিটির সত্যতা যাচাইয়ে কি ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারে গত ৫ মার্চ ‘পঞ্চগড়ে গুজব ছড়িয়ে সড়ক অবরোধ, গাড়িতে আগুন‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।
প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, ‘শনিবার রাত ৮টার দিকে কয়েকজন যুবক মোটরসাইকেল নিয়ে শহরের মোড়ে মোড়ে গিয়ে গুজব রটায় যে আহমেদনগরে আহমেদিয়া সম্প্রদায়ের লোকজন দুজনকে হত্যা করেছে। এই গুজব রটানোর আধা ঘণ্টার মধ্যে কয়েকশ উচ্ছৃঙ্খল যুবক সড়কের খাবারের হোটেলগুলো থেকে জ্বালানি কাঠ ও লাঠিসোটা নিয়ে অবস্থান নেন। তারা শহরের ধাক্কামারা এলাকায় জড়ো হয়ে ঢাকা-পঞ্চগড় মহাসড়ক অবরোধ করেন। পুলিশ তাদেরকে সরিয়ে দিলে তারা আধা কিলোমিটার দূরে মহাসড়কের ট্রাক টার্মিনালের সামনে গিয়ে অবরোধ করেন। সেখানে আরও কয়েকশ বিক্ষুব্ধ মানুষ জড়ো হন। এক পর্যায়ে তারা একটি গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেন।’
পরবর্তীতে পঞ্চগড় জেলা পুলিশের ফেসবুক পেইজ জেলা পুলিশ, পঞ্চগড়-District Police, Panchagarh এ একইদিনে পঞ্চগড়ে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের লোকজন ০২ জন মুসলমানকে গলা কেটে হত্যার গুজব সৃষ্টিকারীকে গ্রেফতার‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি খুঁজে পাওয়া যায়।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিটি থেকে জানা যায়, পঞ্চগড় জেলা শহরে কাদিয়ানীরা ২ জন মুসলমানকে জবাই করে হত্যা করেছে মর্মে গুজব সৃষ্টিকারী পৌর বিএনপি নেতা মোঃ ফজলে রাব্বী(৩০) কে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃত যুবদল নেতা ফজলে রাব্বি আরও একজনকে মোটর সাইকেলে নিয়ে পঞ্চগড় শহরের বিভিন্নস্থানে গুজব ছড়ায় যে কাদিয়ানীরা জবাই করে দুইজনকে হত্যা করেছে।যেটি ফেসবুক সহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। গুজব সৃষ্টিকারী দুষ্কৃতিকারীদের গ্রেপ্তার অভিযান অব্যাহত আছে। গুজবের ঘটনায় ভাঙচুর লুটপাটের সাথে জড়িত সন্দেহে ১৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এছাড়া পঞ্চগড় জেলা প্রেস ক্লাবের সভাপতি ও শহীদ জিয়াউর রহমান ডিগ্রী কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল আনিস প্রধান তার ফেসবুক একাউন্টে ‘পঞ্চগড় জেলা শহরে গুজব, জুতার শোরুমসহ ৩ দোকান লুট ভাংচুর‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি পোস্টে লিখেন, পঞ্চগড়ের তুলার ডাংগা বস্তিতে ২ জনকে জবাই করে হত্যা করা হয়েছে মর্মে গুজব উঠে। গুজবে আতংকিত জেলা শহরের ব্যবসায়ীরা তাদের দোকান পাট বন্ধ করে দিক বিদিক ছুটতে থাকে। ঠিক একি সময় কিছু সুযোগ সন্ধানী উচ্ছৃঙ্খল জনতা শহরের ফল পট্টিতে ওয়ালকার জুতার অত্যাধুনিক শো রুমে লুট পাট ও ভাংচুর সহ পাশে ২ টি কাচ বিক্রির দোকানেও ভাংচুর করে।
পাশাপাশি জাতীয় দৈনিক আজকের পত্রিকা এ ঘটনায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে পঞ্চগড় সদর থানার ডিউটি অফিসার এএসআই তরুণকে উদ্ধৃত করে জানান, গুজবের ঘটনায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং করা হয়েছে। গুজব রটনার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১৯ জনকে আটকও করা হয়েছে।
অর্থাৎ পঞ্চগড়ে কাদিয়ানীরা মুসলমানদের বাড়িতে আগুন এবং দুইজন মুসলমানকে হত্যার দাবিতে প্রচারিত তথ্যটি সম্পূর্ণ গুজব।
মূলত, পঞ্চগড়ের আহম্মদনগর এলাকায় আহমদিয়া সম্প্রদায়ের তিন দিনব্যাপী সালানা জলসার আয়োজন করা হয়েছিল। পরবর্তীতে বেশ কয়েকটি ধর্মভিত্তিক কয়েকটি সংগঠনের প্রতিবাদের মুখে এই জলসা বন্ধ ঘোষণা করা হলেও এর মধ্যেই পঞ্চগড়ে কাদিয়ানীরা মুসলমানদের বাড়িতে আগুন দিয়েছে এবং দুই জনকে হত্যা করেছে দাবিতে একটি তথ্য ছড়িয়ে পড়ে। তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে দেখা যায়, পঞ্চগড়ে কাদিয়ানী কর্তৃক মুসলমানদের বাড়িতে আগুন ও দুই জনকে হত্যার দাবিতে প্রচারিত তথ্যটি গুজব এবং এই ঘটনায় গুজব সৃষ্টির অভিযোগে ১৯ জনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, পঞ্চগড়ের আহম্মদনগর এলাকায় আহমদিয়া সম্প্রদায়ের আয়োজিত তিনদিন ব্যাপী উক্ত সালানা জলসা বন্ধের দাবিতে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের পঞ্চগড় শাখা, সম্মিলিত খতমে নবুয়ত সংরক্ষণ পরিষদ, ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটি, ইমাম-মুয়াজ্জিন কল্যাণ সমিতি, পঞ্চগড় কওমি ওলামা পরিষদ ও জাতীয় ওলামা-মাশায়েখ আইম্মা পরিষদের নেতা-কর্মীরা জেলা প্রশাসকের কাছে গত বৃহস্পতিবার স্মারকলিপি দেয়। এরপর গত শুক্রবার ইসলামী আন্দোলনসহ ধর্মভিত্তিক কয়েকটি সংগঠনের নেতা-কর্মীরা বিক্ষোভ মিছিল করে।এ সময় মিছিলে বাধা দেওয়ায় বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষে আহত আরিফুর রহমান নামে একজন হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান। এছাড়া আহমদিয়া সম্প্রদায়ের (কাদিয়ানি) সালানা জলসা বন্ধের দাবিতে বিক্ষোভের সময় বিক্ষোভকারীরা জাহিদ হাসান নামে একজন কাদিয়ানিকে পিটিয়ে মেরেছেন বলে অভিযোগ করেছেন পঞ্চগড় জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) এসএম সিরাজুল হুদা।
সুতরাং, পঞ্চগড়ে কাদিয়ানীরা মুসলমানদের বাড়িতে আগুন দিয়েছে এবং দুইজন মুসলমানকে হত্যা করেছে দাবিতে প্রচারিত তথ্যটি সম্পূর্ণ গুজব।