সম্প্রতি “ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ পাদ্রি ফাদার হিলারিয়ান হেইগি!” শীর্ষক একটি তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে এসেছে। এই তথ্যের সত্যতার বিষয়ে জানতে চেয়ে রিউমর স্ক্যানারের ফেসবুক গ্রুপেও অসংখ্য ফ্যাক্টচেক অনুরোধ এসেছে।
ফেসবুকের পোস্টগুলোতে বলা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ পাদ্রি ফাদার হিলারিয়ান হেইগি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন।
এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
একই দাবিতে বাংলাদেশের গণমাধ্যমেও প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
ইসলাম গ্রহণের পর হেইগি নিজের নাম আব্দুল লতিফ রেখেছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে।
দেশের গণমাধ্যমে এ বিষয়ে প্রকাশিত কিছু প্রতিবেদন দেখুন বাংলাদেশ বুলেটিন এবং ঢাকা মেইল।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের পাদ্রি ফাদার হিলারিয়ান হেইগির ইসলাম গ্রহণের দাবিটি সত্য। গত বছরের নভেম্বরে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন।
অনুসন্ধানের শুরুতে আমরা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে এ বিষয়ে কোনো সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে কিনা তা জানতে প্রাসঙ্গিক কিওয়ার্ড সার্চ করে ভারতীয় কিছু সংবাদমাধ্যমে (এই সময়, Zee News) একই তথ্য দেখতে পেয়েছি।
পরবর্তীতে আমরা মার্কিন ধর্মীয় বিশেষায়িত সংস্থা ‘Catholic’ এর ওয়েবসাইটে গত ২২ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত একটি ব্লগ পোস্ট খুঁজে পাই। ক্যাথলিকের পাবলিশিং ডিরেক্টর টড আগলিয়ালোরো’র (Todd Aglialoro) লেখা ব্লগটিতে হেইগির মিডিয়াম অ্যাকাউন্টের বরাতে আলোচিত তথ্যগুলো এসেছে।
মার্কিন আরেক খ্রিস্টান সংবাদ ভিত্তিক ওয়েবসাইট ‘The Christian Post’ এ গত ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনেও হেইগির মিডিয়াম অ্যাকাউন্টের একাধিক পোস্টের তথ্য উল্লেখ করে তার ইসলাম ধর্ম গ্রহণের বিষয়টি এসেছে।
প্রতিবেদনে মার্কিন খ্রিস্টীয় মঠ (Monastery) ‘Holy Transfiguration Monastery’ এর ফেসবুক পেজে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত একটি পোস্টের প্রসঙ্গ এসেছে। পোস্টে বলা হয়, “তিনি (হেইগি) সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন যে তিনি ২০ বছর আগে থেকে ইসলামের সুফি ঐতিহ্যের প্রতি আগ্রহী ছিলেন।”
অর্থাৎ, হিলারিয়ান হেইগির ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার বিষয়ে সকল আলোচনার সূত্র হিসেবে ব্যবহার হয়েছে একটি মিডিয়াম অ্যাকাউন্ট।
আলোচিত সেই মিডিয়াম অ্যাকাউন্ট
অনুসন্ধানে মিডিয়ামে হিলারিয়ান হেইগির অ্যাকাউন্টটি খুঁজে পেয়েছি আমরা। অবশ্য, অ্যাকাউন্টের নাম হিলারিয়ান হেইগি নয়, এটির নাম সাইদ আবদুল লতিফ (Said Abdul Latif)।
২০২২ সালের এপ্রিলে চালু করা এই অ্যাকাউন্টের ‘About’ সেকশনে থেকে জানা যায়, হেইগি অর্থাৎ সাইদ আবদুল লতিফ সম্প্রতি ইসলাম গ্রহণ করেছেন।
আজ ১ মার্চ সকালে সাইদের মিডিয়াম অ্যাকাউন্টটি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, তিনি তখন পর্যন্ত অ্যাকাউন্টে ১০টি ব্লগ পোস্ট করেছেন।
গত বছরের (২০২২) ০২ অক্টোবর প্রকাশিত প্রথম ব্লগে তিনি লিখেছেন, “আমি কে? আমি বর্তমানে এক, পবিত্র, ক্যাথলিক এবং অ্যাপোস্টলিক চার্চে একজন যাজক। একজন ‘প্রথাগত’ পুরোহিত। এই মুহুর্তে, আমি এক ধরণের আধা-বেসরকারী ছুটিতে আছি যখন আমারইসলামে যাওয়ার বাস্তব ব্যবস্থা চূড়ান্ত করা হয়েছে।”
জনাব সাইদ তার এই ব্লগে ইসলামের পথে তার আগ্রহ জন্মানোর প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেছেন। তিনি বৌদ্ধ ধর্মের বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন, জালাল উদ্দীন রুমির সম্পর্কে জানতে পেরে সুফিবাদ সম্পর্কে ধারণা পেয়েছেন। ইসলামের বিষয়ে তার ছোটবেলাতেই জানার সুযোগ হয়। তখন ইসলামের মূল নীতি বা স্তম্ভের বিষয়ে সম্যক জ্ঞান লাভ করেন বলে তিনি তার ব্লগে লিখেছেন। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলার বিষয়টিও এসেছে তার লেখায়।
সাইদ ২০০৩ সালেই মুসলিম হতে চেয়েছিলেন। লিখেছেন, “আমি এর (ইসলামের) সৌন্দর্য ও গভীরতা দেখেছি। দেখেছি এর সত্যতা। আমি ধর্মান্তরিত হওয়ার বিষয়ে ইমামের সাথে কথা বলেছি। আমি স্থানীয় ইসলামিক সেন্টারেও কথা বলেছি। মুসলিম বন্ধু বানিয়েছি। এটি একটি সুন্দর এবং আনন্দের মুহূর্ত ছিল। কিন্তু আমি ধর্মান্তরিত হইনি। সেই সময়ে, আমি এই ধরনের একটি রূপান্তর সম্পর্কে খুব ভয় পেয়েছিলাম।”
তার ভয়ের পেছনে তিনি তার মা বাবা, পরিবার এবং সমাজের ভাবনাকে সামনে এনেছেন একই ব্লগে।
জনাব সাইদ একই লেখার দ্বিতীয় একটি অংশ প্রকাশ করেন ০৫ অক্টোবর, যেখানে তিনি উল্লেখ করেন ২০১০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ইসলামের সাথে তার অনেকটা ‘লাভ-হেট রিলেশনশিপ’ ছিল। এ সময়ে বিভিন্ন দেশে হওয়া যুদ্ধ তাকে ভাবিয়েছে।
একই লেখার ৩য় আরেকটি অংশ তিনি প্রকাশ করেন গত ১০ জানুয়ারি।
তবে এটির আগে ২৭ ডিসেম্বর ‘Heading East’ শিরোনামে প্রকাশিত আরেক ব্লগ পোস্টে তিনি লিখেছেন, “একজন মুসলিম হিসেবে আমার নতুন জীবন শুরু করার জন্য, আমি পূর্ব দিকে, আমার বাড়িতে ফিরে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি, যেখানে প্রায় ২০ বছর আগে জং বেল্টের একটি বিশ্ববিদ্যালয় শহরের একটি ছোট্ট ইসলামিক কেন্দ্রে আমার ইসলামের প্রতি যাত্রা শুরু হয়েছিল।”
সাইদ তার ব্লগে লিখেছেন, “এভাবেই উম্মাহর দিকে আমার পথচলার শুরু। অল্প টাকা, আমার ফোর্ড গাড়ি, কিছু বই, কাপড় আর অল্প আরবী জ্ঞান-ই আমার সম্বল।”
সাইদ উল্লেখ করেছেন, তিনি মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছ থেকে যে উষ্ণতা এবং আতিথেয়তা পেয়েছেন তা অসাধারণ। এমন আতিথেয়তার অভিজ্ঞতা তিনি কখনো পাননি। তার ভবিষ্যত অনিশ্চিত কিন্তু তবুও তিনি শান্তি অনুভব করছেন।
হেইগি লিখেছেন, “বিশ বছর ধরে ইসলামের প্রতি আমার টান অবশেষে আমাকে ঘরে নিয়ে গেছে। এখন ঈমানের গভীরে প্রবেশের কাজ শুরু। একটি গভীর শিক্ষার কাজ। দ্বীনের প্রতি ভালোবাসার কাজ। উম্মাহর প্রতি ভালোবাসার কাজ। রাসুল (সাঃ) এর প্রতি ভালবাসার কাজ।”
সাইদের ইসলাম গ্রহণের বিষয়ে আলোচনার শুরু তার সর্বশেষ ব্লগ পোস্টের পর। গত ২০ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত পোস্টে তিনি লিখেছেন, “যেহেতু আমার ইসলাম গ্রহণের খবর এখন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ্যে এসেছে, আমার ইনবক্স মেসেজে ভর্তি হয়ে গেছে এবং আমার ফোনে একের পর এক কল আসছে।”
ব্লগে তিনি কিছু সোর্সের লিস্ট দিয়েছেন যা তাকে প্রভাবিত করেছে ইসলাম গ্রহণে।
অর্থাৎ, সাইদ আল লতিফের মিডিয়াম অ্যাকাউন্ট পর্যবেক্ষণ করে জানা যাচ্ছে, তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছেন এবং বিষয়টি সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশ্যে এসেছে।
ভিন্ন সূত্রের খোঁজ
ফাদার হিলারিয়ান হেইগি ওরফে সাইদ আল লতিফের ইসলাম গ্রহণের বিষয়ে জানতে আমরা ভ্যাটিকান এবং ক্যাথলিক চার্চের বিষয়ে মার্কিন প্রতিষ্ঠান ‘Crux’ এর ওয়েবসাইটে ২০১৯ সালের ২০ এপ্রিল প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাই, যেখানে হেইগির একটি ছবি যুক্ত রয়েছে।
ছবির ক্যাপশন থেকে জানা যায়, হেইগি সেসময় “Holy Resurrection Monastery” নামক একটি মঠের সাথে যুক্ত ছিলেন।
মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক সংবাদ সংস্থা ‘The Middle East Monitor (MEMO)’ এর ওয়েবসাইটে হেইগির ইসলাম গ্রহণের বিষয়ে এক প্রতিবেদনেও উক্ত মঠের বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। গত ২৬ ফেব্রুয়ারির উক্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, হেইগি Holy Resurrection Monastery থেকে বাইজেন্টাইন ক্যাথলিক যাজক হওয়ার জন্য গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন।
অনুসন্ধানে আমরা ‘Holy Resurrection Monastery’ এর ফেসবুক পেজে আজ ১ মার্চ প্রকাশিত একটি পোস্ট খুঁজে পেয়েছি, যেখানে বলা হয়েছে, “আমরা এই মুহূর্তে ট্রয় (ফাদার হিলারিয়ন) হেইগির জন্য প্রার্থনা করছি যিনি সম্প্রতি ধর্মত্যাগ করেছেন।”
অর্থাৎ, ভিন্ন সূত্রেও হেইগির ইসলাম গ্রহণের বিষয়টি জানা যাচ্ছে।
কী বলছেন সাইদ আবদুল লতিফ?
ইসলাম গ্রহণের বিষয়ে জানতে রিউমর স্ক্যানার টিম যোগাযোগ করেছিল ফাদার হিলারিয়ান হেইগি ওরফে সাইদ আবদুল লতিফের সাথে। আজ (১ মার্চ) দুপুরে রিউমর স্ক্যানারকে তিনি জানান, তার ইসলাম গ্রহণের বিষয়টি সত্য।
সাইদ জানান, তিনি সম্প্রতি বিষয়টি প্রকাশ্যে এনেছেন। তবে গোপনে নভেম্বর থেকেই ইসলামের পথে রয়েছেন।
অর্থাৎ, ফাদার হিলারিয়ান হেইগি ইসলাম গ্রহণ করেছেন বলে নিজেই নিশ্চিত করেছেন।
ফেসবুকে সাইদের পূর্ব নাম ‘হিলারিয়ান হেইগি’র নামে একাধিক পেজ ( দেখুন ১, ২, ৩) খুঁজে পেয়েছি আমরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাইদ রিউমর স্ক্যানারকে বলেছেন, “মিডিয়াম ব্যতীত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমার অন্য কোনো অ্যাকাউন্ট নেই। আমি মানুষকে বলেছি আমার নাম ব্যবহার করে কোনো অ্যাকাউন্ট দেখলে তা রিপোর্ট করে দিতে।”
মূলত, গত ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের পাদ্রি ফাদার হিলারিয়ান হেইগি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন শীর্ষক একটি তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে আসার প্রেক্ষিতে অনুসন্ধানে দেখা যায়, দাবিটি সত্য। ইসলাম গ্রহণের পর তার বর্তমান নাম সাইদ আবদুল লতিফ রাখা হয়েছে। ইসলাম গ্রহণের বিষয়টি তিনি নিজেই রিউমর স্ক্যানারকে নিশ্চিত করেছেন।
সুতরাং, যুক্তরাষ্ট্রের পাদ্রি ফাদার হিলারিয়ান হেইগির ইসলাম গ্রহণের দাবিটি সত্য।