সম্প্রতি, ‘নতুন বছরের(২০২৩) পাঠ্যবইয়ে মুসলিম রাষ্ট্রে বিধর্মীদের শাসন ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে’ শীর্ষক দাবিতে ফেসবুকে কিছু তথ্য প্রচার করা করা হচ্ছে।
তথ্যগুলো হচ্ছে
📖 ক্লাস টু এর বই থেকে
প্রিয় নবীর সংক্ষিপ্ত জীবনী বাদ দিয়েছে।
📖 ক্লাস থ্রি এর বই থেকে
খলিফা আবু বক্কর এর জীবনী বাদ দিয়েছে।
📖 ক্লাস ফোর এর বই থেকে
খলিফা ওমর (রা) এর জীবন বাদ দিয়েছে।
📖 ক্লাস ফাইভ এর বই থেকে
নবীজির বিদায় হজের ভাষণের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা বাদ দিয়েছে পাশাপাশি সংযুক্ত করেছে বই নামের একটি কবিতা যা কোরআন বিরোধী।
📖 ক্লাস সিক্স এর বইতে সংযুক্ত করেছে লাল গরু নামের একটি গল্প, যা মুসলিমদের বাধ্য করছে গরুকে মা বলে সম্বোধন করতে,পাশাপাশি শিক্ষা দিচ্ছে গরু জবাই করা একটি মহা অন্যায়।
📖 ক্লাস সেভেন এর বই তে সংযুক্ত করেছে, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখিত লালো নামের একটি গল্প, যা মুসলিমদের কালী পূজা করতে উদ্বুদ্ধ করছে। এবং ক্লাস এর বইতে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত এর ৫ টা পর্দা বিরোধী গল্প রয়েছে। যা বাচ্চাদের মনে ছোট থেকেই পর্দার প্রতি অনিহা বোধ সৃষ্টি করে।
📖 ক্লাস এইট এর বই তে আরো সংযুক্ত করা হয়েছে হিন্দুদের রামায়ণ নামের গ্রন্থ। যা সরাসরি মুসলিমদের হিন্দু ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করছে।
উল্লিখিত দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে ও এখানে।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, নতুন বছরের(২০২৩) পাঠ্যক্রমে বিভিন্ন শ্রেণির বই হতে ইসলামিক গল্প/প্রবন্ধ/কবিতা বাদ দিয়ে হিন্দুধর্ম সম্পর্কিত গল্প/প্রবন্ধ/কবিতা যুক্ত করা হয়েছে দাবিতে ফেসবুকে যে তথ্যগুলো প্রচার করা হচ্ছে সেগুলো সঠিক নয় বরং যেসকল ইসলামি গল্প/প্রবন্ধ/কবিতা বাদ দেওয়া হয়েছে বলে ফেসবুকে প্রচার করা হচ্ছে সেগুলো বাদ দেওয়া হয়নি এবং হিন্দুত্ববাদী যেসকল গল্প/প্রবন্ধ/কবিতা যুক্ত করা হয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে সেগুলো বর্তমান পাঠ্যক্রমেই নেই। তবে, সপ্তম শ্রেণির পাঠ্য বইয়ে বেগম রোকেয়ার অবরোধবাসিনী প্রবন্ধ অবলম্বনে পর্দা প্রথা বিরোধী ৫ টি গল্প উল্লেখ থাকার দাবিটি সত্য।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, হিন্দু ধর্ম সম্পর্কিত যেসব গল্প/কবিতা/প্রবন্ধ পাঠয়বইয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে সেগুলো ২০১৭ সালের পূর্বে পাঠ্যবইয়ে সংযুক্ত ছিল। তবে এগুলো বর্তমান পাঠ্যবইয়ে নেই বরং ২০১৭ সালেই এগুলো পাঠ্যবই হতে বাদ দেয়া হয়েছে।
প্রথম দাবি যাচাই
দাবি
দ্বিতীয় শ্রেণির বাংলা পাঠ্যবই হতে মহানবী (সা.) এর জীবনী শীর্ষক ‘সবাই মিলে করি কাজ’ প্রবন্ধটি বাদ দেওয়া হয়েছে।
ফ্যাক্ট
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, উক্ত প্রবন্ধটি পাঠ্যবই হতে বাদ দেওয়া হয়নি বরং বর্তমান পাঠ্যক্রমের দ্বিতীয় শ্রেণির বাংলা বইয়ের ৭১ পৃষ্ঠায় এটি বিদ্যমান রয়েছে।
দ্বিতীয় দাবি যাচাই
দাবি
তৃতীয় শ্রেণির বাংলা পাঠ্যবই হতে খলিফা হযরত আবু বকর (রাঃ) এর জীবনী বাদ দেওয়া হয়েছে।
ফ্যাক্ট
অনুসন্ধানে জানা যায়, উক্ত বিষয়টি পাঠ্যবই হতে বাদ দেওয়া হয়নি বরং বর্তমান পাঠ্যক্রমের তৃতীয় শ্রেণির বইয়ে এটি রয়েছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এর ২০২৩ সালের তৃতীয় শ্রেণির বাংলা বইয়ের ৯৯ তম পৃষ্ঠায় খলিফা আবু বকর (রাঃ) নামে তার জীবনী নিয়ে লেখা প্রবন্ধটি খুঁজে পাওয়া যায়।
তৃতীয় দাবি যাচাই
দাবি
৪র্থ শ্রেণির পাঠ্যবই হতে খলিফা হযরত ওমর (রাঃ) এর জীবনী বাদ দেওয়া হয়েছে।
ফ্যাক্ট
অনুসন্ধানে দেখা যায়, উক্ত বিষয়টি পাঠ্যবই হতে বাদ দেয়া হয়নি বরং বর্তমান পাঠ্যক্রমের চতুর্থ শ্রেণির বাংলা বইয়ে এটি রয়েছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এর ২০২৩ সালের চতুর্থ শ্রেণির বাংলা বইয়ের ৯৭ নম্বর পৃষ্ঠায় খলিফা হযরত ওমর (রা) নামে হযরত ওমর (রাঃ) এর জীবনী নিয়ে লেখাটি রয়েছে।
চতুর্থ দাবি যাচাই
দাবি
পঞ্চম শ্রেণির পাঠ্যবই হতে ‘বিদায় হজ’ প্রবন্ধটি বাদ দেওয়া হয়েছে।
ফ্যাক্ট
অনুসন্ধানে দেখা যায়, পঞ্চম শ্রেণির পাঠ্যবই হতে ‘বিদায় হজ’ প্রবন্ধটি বাদ দেওয়া হয়নি বরং বর্তমান পাঠ্যক্রমে পঞ্চম শ্রেণির বইয়ে এটি বিদ্যামান রয়েছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এর ২০২৩ সালের পঞ্চম শ্রেণির বাংলা বইয়ের ৯৫ তম পৃষ্ঠায় ‘বিদায় হজ’ শীর্ষক প্রবন্ধটি খুঁজে পাওয়া যায়।
পঞ্চম দাবি যাচাই
দাবি
পঞ্চম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে ‘বই’ নামের কথিত কোরআন বিরোধী একটি কবিতা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
ফ্যাক্ট
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পঞ্চম শ্রেণির বর্তমান পাঠ্যক্রমে ‘বই’ নামের কোন কবিতা নেই। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এর ২০২৩ সালের পঞ্চম শ্রেণির বাংলা বইয়ে‘বই’ নামে কোনো কবিতা খুঁজে পাওয়া যায়নি।
ষষ্ঠ দাবি যাচাই
দাবি
ষষ্ঠ শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে ‘লাল গরু’ নামের কথিত হিন্দুত্ববাদী প্রবন্ধ যুক্ত করা হয়েছ।
ফ্যাক্ট
অনুসন্ধানে জানা যায়, ষষ্ঠ শ্রেণির বর্তমান পাঠ্যবইয়ে ‘লাল গরু’ নামের কোন প্রবন্ধ নেই। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এর ২০২৩ সালের ষষ্ঠ শ্রেণির বাংলা বইয়ে‘লাল গরু’নামের কোনো প্রবন্ধ খুঁজে পাওয়া যায়নি।
সপ্তম দাবি যাচাই
দাবি
সপ্তম শ্রেণীর পাঠ্যবইয়ে ‘লালো’ নামের একটি গল্প আনা হয়েছে, যেখানে কালী পূজা এবং পাঠা বলির গল্প রয়েছে৷
ফ্যাক্ট
অনুসন্ধানে সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে ‘লালো’ নামের কোন গল্প পাওয়া যায়নি।জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এর ২০২৩ সালের সপ্তম শ্রেণির বাংলা বইয়ে ‘লালো’ নামের কোনো গল্প নেই।
অষ্টম দাবি যাচাই
দাবি
সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত এর ৫ টি পর্দা বিরোধী গল্প রয়েছে। যা বাচ্চাদের মনে ছোট থেকেই পর্দার প্রতি অনিহা বোধ সৃষ্টি করে।
ফ্যাক্ট
অনুসন্ধানে সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত এর অবরোধবাসিনী প্রবন্ধ অবলম্বনে লেখাপর্দা প্রথা বিরোধী ৫ টি গল্প খুঁজে পাওয়া যায়। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এর ২০২৩ সালের সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুশীলন বইয়ের ১২১ নাম্বার পেজে ‘অবরোধবাসিনীর কাহিনি’ শিরোনামে উক্ত গল্পগুলো খুঁজে পাওয়া যায়।
নবম দাবি যাচাই
দাবি
অষ্টম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে হিন্দুদের রামায়ণ নামের গ্রন্থ।
ফ্যাক্ট
অনুসন্ধানে অষ্টম শ্রেণির পাঠ্যসূচিতে হিন্দুধর্মের রামায়ণ কাহিনী সম্পর্কিত কোনো বিষয় পাওয়া যায়নি।জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এর ২০২২ সালের অষ্টম শ্রেণির আনন্দ পাঠ(বাংলা দ্রুত পঠন)এবং সাহিত্য কণিকা বইয়ে এই নামের কোনো গল্প নেই।
অপরদিকে অনুসন্ধানে ২০১৭ সালের ২ জানুয়ারি দৈনিক সমকালে “পাঠ্যপুস্তকে বাদ যাওয়া লেখা পড়বে শিশুরা” শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। উক্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, হিন্দুয়ানি লেখা অভিযোগ তুলে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ ২০১৬ সালের ৮ এপ্রিল একটি যৌথ বিবৃতির মাধ্যমে বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত ১২টি কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধকে বাদ দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানায়। হেফাজতের বাদ দেয়ার সুপারিশকৃত ১২ টি গল্প, প্রবন্ধ-কবিতাগুলো হলো-
হুমায়ুন আজাদের কবিতা ‘বই’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা ‘বাংলাদেশের হৃদয়’, সত্যেন সেনের ছোটগল্প ‘লাল গরুটা’, এস ওয়াজেদ আলীর ভ্রমণ কাহিনী ‘রাঁচি ভ্রমণ’, শরৎচন্দ্র চট্টোপ্যাধায়ের ‘লালু’, ‘রামায়ণ’ সংক্ষিপ্ত রূপ, ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের কবিতা ‘আমার সন্তান’, সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ভ্রমণ কাহিনী ‘পালামৌ’, লালন শাহের গান ‘সময় গেলে সাধন হবে না’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা ‘সাঁকোটা দুলছে’, জ্ঞানদাসের কবিতা ‘সুখের লাগিয়া’। এই ১২টি লেখা ২০১৩ সালে পাঠ্যবইয়ে যুক্ত করা হয়েছিল।
হেফাজতের সুপারিশে পরবর্তীতে ২০১৭ সালের পাঠ্যক্রম থেকে পুরনো ২২টি কবিতা এবং গল্প-প্রবন্ধ বাদ দেওয়া হয়। সেসময়-ই সম্প্রতি ফেসবুকে নতুন বছরের পাঠ্যবইয়ে হিন্দুত্ববাদী কবিতা যুক্ত করা হয়েছে দাবিতে যে কবিতা-গল্প-প্রবন্ধগুলো উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো বাদ দেয়া হয়।
এছাড়াও ২০১৭ সালের ১৫ জানুয়ারিতে প্রকাশিত প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, হেফাজতের সুপারিশে ২০১৭ সালের পাঠ্যক্রমে দ্বিতীয় শ্রেণির ‘আমার বাংলা বই’য়ে ‘সবাই মিলে করি কাজ’, তৃতীয় শ্রেণিতে ‘খলিফা হযরত আবু বকর’, চতুর্থ শ্রেণির বাংলা বইয়ে ‘খলিফা হযরত উমর (রা.) এবং ৫ম শ্রেণির বইয়ে শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’, ‘বিদায় হজ’ ও ‘শহিদ তিতুমীর’ যুক্ত করা হয়। উল্লেখ্য এ গল্প-কবিতা-প্রবন্ধগুলো পূর্বে ছিলো এবং তা ২০১৩ সালের বাদ দেয়া হয়েছিল যা হেফাজতের সুপারিশে ২০১৭ সালে পাঠ্যসূচিতে পুনরায় যুক্ত করা হয়।
মূলত, ফেসবুকে নতুন বছরের বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে বিতর্কিত পরিবর্তন দাবিতে যে তথ্যগুলো উপস্থাপন করা হয়েছে তা ২০১৪ এর পর এবং ২০১৭ এর পূর্বের সময়ের আলোচ্য বিষয় ছিলো। সেসময় পাঠ্যবইয়ে সাম্প্রতিক ফেসবুকে প্রচারিতগুলো বিষয় বাদ দেয়া এবং যুক্ত করার বিষয়টি ঘটেছিল। ২০১৭ সালে হেফাজতে ইসলামের সুপারিশে বর্তমানে ফেসবুকে উল্লিখিত বাদ দেওয়া বিষয়গুলো ফিরিয়ে আনা হয় এবং ফেসবুকে উল্লিখিত ২০১৪ সালে যুক্ত করা বিষয়গুলো বাদ দেওয়া হয়। তবে, সপ্তম শ্রেণির পাঠ্য বইয়ে বেগম রোকেয়ার অবরোধবাসিনী প্রবন্ধ অবলম্বনে পর্দা প্রথা বিরোধী ৫ টি গল্প উল্লেখ থাকার দাবিটি সত্য।
উল্লেখ্য, পাঠ্যবই সম্পর্কে প্রায় একই দাবিগুলো ২০২২ সালে জাতীয় সংসদ অধিবেশনে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য জনাব ফখরুল ইমাম উপস্থাপন করলে সেসময় দাবিগুলোকে মিথ্যা হিসেবে শনাক্ত করে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল রিউমর স্ক্যানার।
অর্থাৎ, ২০২৩ সালের বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে বিতর্কিত পরিবর্তন দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত ৯ টি তথ্যের মধ্যে ৮ টি তথ্যই মিথ্যা।